ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের বিস্তারিত বিশ্লেষণ
গণতন্ত্র হলো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত এবং শাসনকার্য পরিচালিত হয় জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে এই ব্যবস্থা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে গণতন্ত্রের কিছু মৌলিক নীতির সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য খুঁজে পান, আবার অনেকে এর মূল দর্শনের সঙ্গে ইসলামের আদর্শের সংঘাত দেখতে পান।
ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণা
ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মহাবিশ্বের একমাত্র সার্বভৌম সত্তা হলেন আল্লাহ তা'আলা। মানুষের কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত আল্লাহর আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"স্মরণ রেখো, সৃষ্টি ও হুকুম তাঁরই জন্য। বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ কতই না কল্যাণময়!"
(সূরা আল-আ'রাফ: ৫৪)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, আইন প্রণয়ন ও শাসন পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত। একজন মুসলিম হিসেবে কোনো মানুষের পক্ষে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা বৈধ নয়, যা আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের পরিপন্থী।
ইসলামে শুরা (পরামর্শ) ব্যবস্থার গুরুত্ব
গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সবচেয়ে বড় মিলটি হলো শুরা বা পরামর্শের নীতি। ইসলামি শাসনব্যবস্থায় পরামর্শ একটি মৌলিক স্তম্ভ। আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূল ﷺ-কে নির্দেশ দিয়েছেন:
"আর তাদের সাথে (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়ে পরামর্শ করো।"
(সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)
এই নির্দেশের পর রাসূল ﷺ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যুদ্ধ বা অন্য কোনো বিষয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতেন। এর মাধ্যমে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার একটি আদর্শ স্থাপিত হয়েছিল। তবে শুরার মাধ্যমে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো অবশ্যই শরীয়াহর সীমানার মধ্যে থাকতে হবে। এটিই শুরার সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্রের মূল পার্থক্য।
গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিক এবং ইসলামি আদর্শের সাথে এর সামঞ্জস্য
ইসলামি চিন্তাবিদরা গণতন্ত্রের কিছু দিককে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেন:
- জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা: গণতন্ত্রে সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। ইসলামেও শাসককে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনকালে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
- স্বৈরাচার প্রতিরোধ: গণতন্ত্র ক্ষমতাকে এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হতে দেয় না, যা স্বৈরাচারী শাসন প্রতিরোধে সহায়ক। ইসলামও ক্ষমতাকে ব্যক্তির পরিবর্তে আদর্শের অধীন করার কথা বলে।
- শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর: নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা: ইসলামে হক বা সত্য কথা বলার অধিকারকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইসলাম ও আধুনিক গণতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য
গণতন্ত্রের কিছু নীতি ইসলামের মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক:
- সার্বভৌমত্ব: গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty), যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস। কিন্তু ইসলামে সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
- আইন প্রণয়ন: আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণ নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে। এমনকি তা যদি ঐশী আইনের পরিপন্থীও হয়। ইসলামে এটি অগ্রহণযোগ্য, কারণ শরীয়াহর সীমা অতিক্রম করার অনুমতি নেই।
- সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত: গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে চূড়ান্ত বলে ধরা হয়। এর ফলে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে যা ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন, মদকে বৈধতা দেওয়া। ইসলামে সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নয়, বরং আল্লাহর বিধান।
উপসংহার ও সমন্বয়ের সম্ভাবনা
ইসলাম ও গণতন্ত্রের সম্পর্ককে পুরোপুরি বাতিল বা গ্রহণ না করে একটি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। এমন একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হবে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই আল্লাহর শরীয়াহর আলোকে হবে। অর্থাৎ, শাসনকার্য পরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে, তবে আইন প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থা হবে ইসলামি নীতির ওপর ভিত্তি করে। এটিই সম্ভবত ইসলামি শাসনব্যবস্থা ও আধুনিক গণতন্ত্রের একটি কার্যকর সমন্বয়। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন, কিন্তু তিনি এবং তার সরকার শরীয়াহর প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন।
তথ্যসূত্র:
- পবিত্র কুরআন: সূরা আল-আ'রাফ (৭:৫৪), সূরা আলে ইমরান (৩:১৫৯)
- ড. ইউসুফ আল-কারাদাভী, ইসলাম ও গণতন্ত্র
- মুহাম্মদ আসাদ, The Principles of State and Government in Islam
- মাওলানা আবুল আ'লা মওদূদী, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা
- ইবনে তাইমিয়া, As-Siyasah ash-Shar’iyyah
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন